এমপি-মন্ত্রীদের ঘুম হারাম রমজানে চলছে ইফতার

ঈদুল ফিতরকে এবার ভোটের ঈদ হিসেবে দেখছেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। আর এই ভোটের ঈদ সামনে রেখে পুরো রমজান মাস নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ইফতারের মাধ্যমে ব্যাপক গণসংযোগ করছেন তারা। শুধু বাজেট অধিবেশনের জন্য দু-চার দিন ঢাকায় থাকলেও এমপিরা এলাকায় বেশি সময় দিচ্ছেন। এবার ঈদে মন্ত্রী, এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ভোটারের মন জয় করতে যত বেশি সম্ভব শাড়ি-লুঙ্গি, কামিজ, পাঞ্জাবি-পায়জামা বিতরণ করছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রায় ৬ মাস আগে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভোটারের কাছাকাছি যেতে রমজান মাসকেই বেছে নিয়েছেন নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সূত্রমতে, মনোনয়নের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন ধরেই দলীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের বলে আসছেন, ‘কারও মুখ দেখে নয়, জরিপ দেখেই মনোনয়ন দেওয়া হবে’। আগামী সংসদ নির্বাচনে কোনো ঝুঁকি নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা পেয়ে দলের এমপি-মন্ত্রীরা নিজ নিজ এলাকামুখী হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই ইফতার পার্টির মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সাধারণ ভোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তারা। চেষ্টা চালাচ্ছেন দলের হাইকমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণের। সর্বোপরি জাতীয় নির্বাচনের আগে শেষ এই রমজান মাসকে কেন্দ্র করে চলছে নির্বাচনী প্রস্তুতি। তবে ইফতার পার্টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত রয়েছেন আওয়ামী লীগের তরুণ মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। ইফতার মাহফিলে বর্তমান সরকারের সাফল্য ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরার পাশাপাশি নৌকার প্রচার-প্রচারণার সঙ্গে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করছেন।

জানা গেছে, সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের মধ্যে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ অধিকাংশই মন্ত্রীই ইতিমধ্যে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কয়েক দফা ঘুরে এসেছেন। তারা দলীয় নেতা-কর্মীদের পাঞ্জাবি-পায়জামা, শাড়িসহ উপহারসামগ্রী দিচ্ছেন। পাশাপাশি গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বস্ত্র ও ঈদসামগ্রী বিতরণ সেরে এসেছেন। ঈদের আগে আবারও এলাকায় যাবেন। বেশির ভাগ নেতা নিজ নিজ এলাকায় ঈদ নামাজ পড়বেন এবং স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এবার ঈদ উদযাপন করবেন।

এ ছাড়াও রমজান মাসের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, বিএম মোজাম্মেল হক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এনামুল হক শামীম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ত্রাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, কৃষি সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, কেন্দ্রীয় নেতা এস এম কামাল হোসেন, রিয়াজুল কবির কাওছারসহ কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ইফতারভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তারা ইফতার পার্টির মাধ্যমে এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করছেন। একই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের জন্য পাঞ্জাবি, শাড়ি, ঈদকার্ড, উপহারসামগ্রী এবং এলাকার গরিব-দুস্থদের মধ্যে কাপড়-শাড়ি লুঙ্গি বিতরণ করে চলেছেন। অনেকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী, সেমাই, লাচ্চা, দুধ, চিনি প্রভৃতি বিতরণ করছেন। সূত্রমতে, নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী রমজানের শুরু থেকেই নির্বাচনী এলাকায় রয়েছেন। মাঝখানে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। ঈদও তিনি দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গেই নির্বাচনী এলাকায় করবেন বলে জানা গেছে। নোয়াখালী-১ আসনের এমপি এইচ এম ইব্রাহিম রমজানের শুরু থেকেই নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ, ইফতার পার্টিতে যোগদান করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জনপ্রতিনিধিরা রমজান মাসে এলাকায় থাকি নেতা-কর্মীরা এমনটা প্রত্যাশা করেন। সে কারণে ইফতার পার্টিতে যোগদান ও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে নির্বাচনী এলাকায় সময় দিচ্ছি।’ কয়েক দিন আগে শরীয়তপুরের সখিপুর ও নড়িয়াতে আশরাফুন্নেসা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করেছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম। এ ছাড়াও তিনি স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসায় ইমাম-আলেম এবং দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। জাকাতের কাপড় বিতরণ করে গরিব-দুঃখীদের এবং ঈদ শুভেচ্ছা পাঞ্জাবি বিতরণ করে নেতা-কর্মীদের আরও কাছে টানার পাশাপাশি এলাকার মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদেরও পাশে টানছেন এমপিরা। মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মধ্যে পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি বিতরণ করছেন এমপিরা। গত শনিবার দিনাজপুর-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী তার নির্বাচনী আসনের ২৪৩ জন ইমামের মাঝে পাঞ্জাবি-পায়জামা ও টুপি বিতরণ করেন। খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জানান, ২৪৩ জন ইমাম রমজানের ঈদের মাঠে নামাজ পড়াবেন। তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি মাত্র। এর মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

বেশ কয়েক বছর ধরে রমজানে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। দক্ষিণের অধীনে ২৪টি থানা, ৭৫টি সাংগঠনিক ওয়ার্ড ও এর অধীনের প্রত্যেকটি ইউনিটের ২৭ হাজার নেতা-কর্মীকে একটি নামিদামি ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি ঈদ উপহার হিসেবে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট বলেন, ‘যুবলীগ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরীর নির্দেশে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতেই গত কয়েক বছর ধরে পাঞ্জাবি বিতরণ করে আসছি। তৃণমূল নেতা-কর্মীই সংগঠনের মূল শক্তি।’ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী-এমপিদের পাশাপাশি ঈদ সামনে রেখে এই রমজান মাসে নিজেদের এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ করছেন সরকারের শরিক ১৪ দলের এমপি-মন্ত্রী-নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও। আওয়ামী জোটের অন্যতম শরিক দল জাসদ সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টি (জেপি) চেয়ারম্যান পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী নিজ নিজ এলাকায় ঘুরে এসেছেন। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার নির্বাচনী এলাকা ঢাকা হওয়ায় তিনি প্রায়ই ইফতারে অংশগ্রহণ ও কাপড়-শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, ভোলা-৩ আসনে নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ভোলা-৪ আসনে আবদুল্লাহ ইসলাম জ্যাকব এবং কুমিল্লা-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এলাকায় ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে ব্যাপক গণসংযোগ করে চলেছেন। নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনে অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান মেহেদী, গাইবান্ধা-৫ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন, চট্টগ্রাম-৬ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন, বাগেরহাট-৪ আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, নোয়াখালী-৬ আসনে মাহমুদ আলী রাতুল ও আমিরুল ইসলাম আমির, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে গোলাম সারোয়ার কবির, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাত, নাটোর-৪ আসনে কোহেলি কুদ্দুস মুক্তি, মাগুরা-১ আসনে সাইফুজ্জামান শিখর, ঝালকাঠি-১ আসনে মনিরুজ্জামান মনির, ঢাকা-৫ আসনে মশিউর রহমান মোল্লা সজল, ঢাকা-৬ আসনে চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলু, ঢাকা-৭ আসনে ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও আকতার হোসেন, কুমিল্লা-৪ আসনে আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা-১৪ আসনে বর্তমান মহিলা এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন, চাঁদপুর-৩ আসনে রেদওয়ান চৌধুরী বোরহান, সিলেট-৫ আসনে অ্যাডভোকেট মোস্তাক আহমেদ, পাবনা-৪ আসনে রফিকুল ইসলাম লিটনসহ বিভিন্ন আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা গণসংযোগ করে চলেছেন। তারাও নেতা-কর্মীদের পাঞ্জাবি-পায়জামা এবং গরিব-দুঃখীদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করছেন।

  • ব্রেকিংবিডিনিউজ২৪ / ১০ জুন ২০১৮ / তানজিল আহমেদ